Monday, April 28, 2014

ঋত্বিক – একটি নদীর নাম



একটি মানসিক হাসপাতাল। নীলকন্ঠ বাগচী ও তাঁর স্ত্রী দূর্গা। এদিকে আলো ক্রমে ক্রমে কমে আসিতেছে। একজন ডাক্তার। তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন নীলকন্ঠের সমস্যা ঠিক কি? ব্যারাম কি মাথার ? না, অন্য কোন গভীর অসুখ এখন গভীরতর। গান ভেসে আসে

আমের তলায় ঝামুর ঝুমুর কলাতলায় বিয়া
আইলেন গো সোন্দরীর জামাই মুকুট মাথায় দিয়া

তিনি জঙ্গলের মধ্যে শুয়ে পড়লেন। পিঠে বন্দুকের বুলেট। ছেলের প্রভাত-সূর্যের রশ্মি-স্নাত মুখ দেখবেন এখন ইচ্ছে ছিল তাঁর। হল না। এরা তাঁর সোনার টুকরো ছেলে সব। এদের আত্মত্যাগের ইতিহাস, ভালবাসার অঙ্গীকার নিয়ে তিনি সন্দিহান হননি কদাপি। এক দমকে ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ঢুকে পড়েন রবীন্দ্রনাথ – “আমার অঙ্গে অঙ্গে কে”… প্রায় লং শটে দেখা যায়। যে কথাগুলো বলানো হচ্ছে নীলকন্ঠের মুখ দিয়ে সেকথাগুলো আর কেউ ওভাবে বলতে পারত না, কোনদিন।

কম্যুনিস্ট পার্টিতে ঢোকা, বেরনো, সেদিনের বাংলাদেশ, ৭০-এর দশকের শুরুর বঙ্গভূমি

।। ঋত্বিক কুমার ঘটক ।।
আলো আরোই কমিয়া আসিল।

বিমলের মা ছিল জগদ্দল। তাই অমন মাতৃহারা কান্না। জগদ্দলকে বাঁচানো যেত না ঋত্বিক যদি ওয়াহিদাকে পাওয়া যেত ? কিন্তু সে তো আরো বেশ কয়বছর পর। ততদিনে প্রথম ছবি রিলিজ করেনি। দ্বিতীয় ছবি চলেইনি। মানুষ আর যন্ত্রের ভালোবাসাটা আমরা কেউ বুঝতেই পারলাম না ! ঋত্বিক যদি কালী ব্যানার্জির জায়গায় উত্তমকুমারকে নিতেন !

একের ভিতর ঢুকে পড়ছে অন্য – “সুবর্ণরেখার মৃত্যুকল্প, বাগদীবউ, তিতাসের জলোচ্ছ্বাস, নাম রেখেছি কোমল গান্ধার। নীতা বাঁচতে চেয়েও পারল না। তবু সে অতিক্রম করে সূদূর নীহারিকা।

সুরমা দেবী ছেড়ে গেলেন ঋত্বিককে, নীলকন্ঠকে। এরপর ফিরেও এলেন, সেবাও করলেন। ঋত্বিক এরপরেও অসুস্থ, আবার সুস্থতা। ফিল্ম ইন্সটিটিউটে চাকরি, ছাত্রদের ভালবাসা। তারপর ইন্দিরা গান্ধীর ওপর তথ্যচিত্র ! অথচ কংগ্রেসের ভূমিকা, নেহরুর বোলচাল নিয়ে বিষোদ্গার ক্ষমা করবেন ঋত্বিক। কিংবা অসংখ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া ছবি, পয়সার বন্টনে টেকনিশিয়ানদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি। আবারও ক্ষমা করবেন।

কমলবাবু এড়িয়ে গিয়েছেন। ভেবেছেন এক স্তব-স্তুতিতে মোড়া মানুষের নাম হল ঋত্বিক কুমার ঘটক।

ঋত্বিক একজন মানুষ ছিলেন তো ? ফ্রেইলটি নিয়েও। কমলবাবুর ছবিতে শুধুই অ্যাসাইলাম, মদ, পাগলামো। যে সময় বেছে নিয়েছেন পরিচালক, তাতে করেও উদ্ধার পাবেন না। এসবের শেষেও আছে দুটো ছবি, একাধিক নাটক। শুধুই মদ্যপান ও হতাশাকে সঙ্গী করে ? তাতে অবিশ্যি মধ্যমেধার বাঙালী সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেওয়াই চলে, আর্ট হয়ে ওঠা যায় না। কমলবাবু, আপনি ঋত্বিকের ভালবাসা দেখতে পেলেন না ? যে ভালবাসায় সব কে অগ্রাহ্য করেও কেন চেয়ে আছ গো মাগেয়ে ওঠা যায়। যে ভালবাসায় তেভাগা থেকে নকশাল আন্দোলন অ্যানালাইজ করেও বলা যায় – “আমি পিপলস্‌ আর্টিস্ট কোমল গান্ধারফ্লপ, ‘সুবর্ণরেখাও। কিন্তু তার পরেও থেমে থাকেনি তাঁর স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ। করেছেন তথ্যচিত্রও, ইচ্ছেতে বা টাকার জন্য। শুধুই ভবা পাগলাকিংবা ক্ষ্যাপা’ – এই ছাঁচে ফেলে দিলে সেই তিমিরেই থেকে যাব যেখানে ঋত্বিকের অনেক অবিমৃষ্যকারী মন্তব্যকেই ওঁর প্রধান বক্তব্য বলে ভ্রম করা হয়।

রামকিঙ্করের ওপর তথ্যচিত্র যেন রামকিঙ্করের ভাস্কর্য। কমলবাবু, আপনার ছবিতে রামকিঙ্কর এলেন না কেন সঠিক অভিনেতা পাওয়া যেত না? সেই ফ্রেম যা ভাস্কর্যের মতোই বোল্ড, বিবেকী, বাঙ্ময়। ঠিক অনেকটা রায়মশাইয়ের ইনার আইছবিতে বিনোদবিহারীর পেন্টিং-এর মতো ফ্লুইডিটি যার সর্বাঙ্গে। এবং জর্জ বিশ্বাস। শুধুমাত্র গণনাট্যের বন্ধু হিসেবে নয়, জর্জ বিশ্বাসের গান না থাকলে দুয়ার ভেঙে পড়তই না ঝড়ে।

ঘরে ফেরার পালায় সবার ঘরে ফেরা হয় না। ঘর হারিয়ে যায়, পালটে যায়। তবু সবাই অনির্নিমেষ চেষ্টা করি মা, মৃত্যু, ভালবাসা। মোদের কোনো দ্যাশ নাই” – সুস্থিতি তাঁর উজ্জ্বলতর দিক না হলেও সুস্থ, স্বাভাবিক ভালবাসা নিয়ে ঋত্বিক কাটিয়ে দেন অনেক বছরই। ডিটেলড্‌ স্ক্রিপ্ট, ইন্ডেক্স করা পরিপাটি।

পরের ছবি নিয়ে কি ভাবলেন ? (প্রবীর সেন কর্তৃক সাক্ষাৎকার, ১৯৭৫)

নবদ্বীপের পাশের কোন একটি মেয়ে, তার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া। তাকে পাড়ার ওই ওয়াগান ব্রেকার্সযারা সব নয়া কংগ্রেস হয়েছেনপাইপ গান ইত্যাদিতারা চেজ করতে আরম্ভ করে। মেয়েটার দোষের মধ্যে দোষ যে সে গরীব এক বামুনের মেয়ে, কাজেই এই গ্রাম ছেড়ে যাবার উপায় নেই। দ্বিতীয় কথা সে দেখতে সুন্দরী। এই ছোঁড়াগুলো পেছনে লেগেছে তো আলটিমেটলি মেয়েটা এই ছোঁড়াগুলো চেজ করতে করতে মেয়েটাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল যে মেয়েটা বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি একটা ভাল শাড়ি পরে আসিভেতরে ঢুকে সে পেছনের ঘর দিয়ে বেরনোর চেষ্টা করেছিলতারপর এই ছোঁড়ারা ধরে অ্যান্ড দে এনজয়ড হার। পর পর চার পাঁচটা ছেলে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে এরি মধ্যে সত্যযুগ’-এর রিপোর্টার ছেলেটা সে এই গ্রামেরই ছেলে সে গিয়ে পৌঁছেছে। সে শুনেএরা আগুন লাগিয়ে, মেয়েটা কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে মারে। এটার ভিত্তিতে আমি একটা ছবি করব।

আজকের ২০১৩তে দাঁড়িয়েও এই গল্প একটুও বেমানান লাগে কি? তখনই, সেই মধ্য ৭০এ ফ্রেমের বাঁদিক থেকে ধোঁয়া উঠিয়ে ছুটে আসে মরুভূমির ট্রেন গুমগুম গুমগুম শব্দ আর সত্যজিতীয় মিউজিক। ক্যামেল রেস দেখতে থাকি আমরা, আত্মবিস্মৃত, বুভুক্ষু প্রায় হলিউডি ওয়েস্টার্ণ।

আমি শুধু এটুকু বলতে চাই যে, আমাদের ঐতিহ্যের মধ্যে বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে আমরা যদি আবার অনুপ্রবেশ না করি তাহলে কোন জাতীয় শিল্পই গড়ে উঠতে পারে না। ছবি তো নয়ই।

ঋত্বিক একটি ভুল পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিলেন। না হলে দেশভাগের ব্যথার সঙ্গে তেভাগার কান্না, মন্বন্তর ঘুরে নকশাল আন্দোলনের ব্যর্থতার বিষ তিনি কন্ঠে ধারণ করেন কেন?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ভাল অভিনেতা, পরিশ্রমীও, কিন্তু অমন নাদুস ভুঁড়ি নিয়ে নীলকন্ঠ ! কেউ বলল, “ওতো ঋত্বিক নয়, ও নীলকন্ঠ!সঠিক যুক্তি, তবে ওইটুকু বুদ্ধি থাকা দরকার যে ঋত্বিকের অনেকটাই নীলকন্ঠের মধ্যে থাকলেও অনেকটাই নেইও। নীলকন্ঠ, আফটার অল, একটা ফিকশনাল চরিত্র। তবু ঋত্বিকদের চরিত্রের কিছু টিপিক্যাল ম্যানারিজমের জন্য যুক্তি, তক্কো আর গপ্পোর নীলকন্ঠকে ভাল করে অবজার্ভ করতে হয়, সেটা রেফারেন্স হিসেবে কিয়ৎ কাজ করতে পারে কিন্তু সেটাই সম্পূর্ণতা নয়। কখনোই। কমলবাবু, ‘যুক্তি…’ তে ঋত্বিক নিজেকে নিয়ে হেসেছেন, বিদ্রূপ করেছেন, তার নেপথ্যে মিথ এবং সত্য মিশে যেতে থাকে। ঋত্বিকের অন্তরকে বুঝতে বারবার অ্যানালাইজ করতে হবে তাঁর ছবিকে (তাঁর কথাতেই – “ঐতিহ্যের মধ্যে বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে”), তাঁর লেখাকে, তাঁর সম্বন্ধে সমসাময়িকদের লেখাকেও পরমহংসের মতো করে।

খারাপ লাগে ভাবতে মৃত্যুর প্রায় চার দশক পরেও ঋত্বিকের কাজকে মূল্যায়ণ করার প্রচেষ্টা নিয়ে কী অনীহা। এখনও সেই সরলীকরণ, সেই আলগা ছুঁড়ে দেয়া চটকদার মন্তব্য। শুধুমাত্র সিনেমাটোগ্রাফির কারুকাজ দিয়ে, সাদা-কালোর দ্যোতনায় ফিল্ম ভাল হয়ে যায় না, ভাল হয়নি, হওয়ার কথা ছিল কি কোনদিন? কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, আপনার ছবিটি ঋত্বিক কুমার ঘটককে নিয়ে একটি অপপ্রচার কারণ, ঋত্বিক কোন মেঘে ঢাকা তারা নন, ঋত্বিক একটি নদীর নাম। ক্ষমা করবেন।।

(প্রথম প্রকাশ - http://bookpocket.net/archives/lekha/ritwik-ekti-nodir-naam)

Sunday, April 27, 2014

বাংলা সিনেমা নিয়ে একটা মনখারাপ



বাংলা সিনেমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বাঙ্গালী নিজে। সেই বাঙালি যে সর্বদা তার্কিক এবং কর্মক্ষেত্রে অচল। সিনেমা শিল্প-মাধ্যমটি নবীন তাই তাকে পেড়ে ফেলতে বাঙ্গালী টাইম নিয়েছে কিছুটা। কিন্তু একবার সত্যজিত, ঋত্বিক, উত্তম হয়ে যাওয়ার পর বাঙ্গালীর পিচ্ছিল গেঁড়ে-ন্যাকামি বেড়েই চলেছে। এই ব্যাধির মুল কারণ হতাশা ও হীনমন্যতা । সামগ্রিক ভারতবর্ষের নিরিখে বাঙ্গালীর অধঃপতন বস্তুটিতে দুটো মজা আছে এক)আধুনিক জীবনে উন্নতির সূচক শুধুমাত্র ব্যবসাবৃত্তি ও তার বৃদ্ধি এই ধারনা যদি অসম্পূর্ণ তথা ভ্রান্ত মনে হয়, বাঙ্গালী তাকে যুক্তি, বুদ্ধি এবং কাজের মাধ্যমে ভুল প্রমানিত না করে ইমোশনালি ইগ্নোর করতে গিয়ে হয়েছে তারই শিকার। এবং দুই) যে পশ্চাৎ-ধাবন নাহোক প্রায় ষাট-সত্তর বছরের বাঙ্গালীর ইতিহাস তার প্রতি মমত্বে তাকে রিলেটিভলি আধুনিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা। অতেব যে সমস্যা আমার, আপনার বাবা-জেঠাও দেখেননি, ভাবটি সেটা বোধহয় এযুগের-ই ট্র্যাজেডী, অতেব কোন অ্যানালাইজ করার প্রয়োজন নেই, তাকে ঘিরে নিজেদের শহীদ বানালেই শ্লাঘা হাওয়া পাবে ।
এই দুইয়ের মেল-বন্ধনে বাঙ্গালীর শিল্প-চেতনায় উঠে আসছে নস্টালজিয়া যা অতীতচারী, কিন্ত মেলানকলিক নয় । শুধুই ধান্দাবাজির প্রিয়-ক্ষত-চুম্বন। তাই বাংলা থিয়েটারের হাঁড়ির দশা বেশ কয়েক দশক ধরেই । থিয়েটারকে ব্যবসায়িক না করে পরীক্ষা-মূলক করতে গেলেও ট্যাঁকের ও বুদ্ধির জোর লাগে। বাঙ্গালীর প্রিয় কেন্দ্রের বঞ্চনা র মত এখানে সিনেমাকে ভিলেন বানিয়ে হা হুতাশ করলে আর যারই হোক, থিয়েটারের কোন লাভ হবে না। যেটা দরকার ছিল সেটা হল সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও তার পতনের সম্ভাব্য বিজ্ঞানী ব্যাখ্যা । কিন্তু এখন তো থিয়েটার মানেই গ্রুপ থিয়েটার যেমন চিন্তাশীল বাংলা পত্রিকা মানে লিটল ম্যাগাজিন অর্থাৎ হাতে গোনা কয়েকটি বাদে বাকিদের কাছে দারিদ্রের দোহাই দিয়ে খারাপ সৃষ্টি বেচে দেওয়ার অধিকার । অথচ এই কলকাতাতেই নাসিরুদ্দীন সাহের নাটকে হাজার টাকার টিকিটে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ থাকে, আর আম-আদমি আতা বাঙালি হাত তালি দিয়েই থাকি, থামতে পারি না। কিছুকাল আগে ফেসবুকের একটি থিয়েটার গ্রুপে টিকিটের দাম বাড়ানোর সাজেশন দিতেই রে রে তেড়ে এলেন সুধীবৃন্দ একে থিয়েটার ধুঁকছে দাম আর বাড়ালে তো আর সাধারণ মানুষ আস্তেই পারবেন না, এবং ভাবটা হল আর্ট ত আমার আপনার জন্মগত অধিকার মশাই, তার কক্ষন দাম বাড়ে? তারা বঝেননি, শুধু দরিদ্র-নারায়ণকে সামনে রেখে খারাপ প্রযোজনা একটা ক্রিমিনাল অফেন্স কারণ কোন শিল্পই আমজনতার জন্য নয়, কোনদিন ছিল ও না, এবং আপনিও গভীরে আমজনতা বল্লে মনের মধ্যে কিছু শ্রেণিকে বাদ দিয়েই ভাবেন । ৫০% লিটল ম্যাগাজিনের যেমন বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত তেমন বেশ কিছু থিয়েটারকেও অবিলম্বে, আবশ্যিকভাবে ।
সিনেমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সিমিলার কিন্তু সেম না। থিয়েটারকে নিয়ন্ত্রণ করে যে বাঙ্গালী সেই একই শ্রেণী ঘোরাফেরা করেন সাহিত্যের আঙ্গিনাতেও সেই এক মিডল ক্লাস, শিক্ষিত, সবজান্তা ।সিনেমার ক্ষেত্রে তার বানিজ্যিক চরিত্রের জন্যই দেখা গেল প্রায় তিন দশক আগে ফাটল ধরল তার জমিতে কমার্শিয়াল বনাম আর্ট । ৫০-৬০ এর দশকে যা ছিল ভাল - মন্দের পার্থক্য, সেই দ্বন্দ্বে ঢুকে গেল পয়সার হিসেব। সেই বিভাজনকে সাদরে আহ্বান করলেন তথাকথিত বুদ্ধিজীবি আর্ট ফিল্ম পরিচালকেরা । যে বানিজ্যের চাহিদায় বন্ধ হয়ে গেসল সাধারণ রঙ্গালয় এবং উদ্ভব হল গ্রুপ থিয়েটারের, সেই একই বানিজ্যিক বৈষম্যে কিন্তু উল্টভাবে টিকে গেল কমার্শিয়াল ছবি । আর সেই গাত্রদাহে আমাদের প্রধান মিডিয়ারা কিছুকাল আগে অব্দিও চূডান্ত অবহেলা করেছেন মূলধারার ছবিকে অন্য-ধারার ছবি করে প্রসেনজিতকে জাতে উঠতে হল, তুলনায় দেব বা জিত কমসময়েই হয়ে গেলেন গ্রহণযোগ্য এও সেই পয়সারই খেল। বাঁদরামো শুরু অবিশ্যি ৭০-এর শেষ দিক থেকেই। বাংলার তৎকালীন নব্য পরিচালকেরা গৌতম, উৎপলেন্দু, বুদ্ধদেব অল্প অল্প হালে পানি পেতে শুরু করেছেন, বিদেশে ছবি ভাল করছে, আর অনবরত বেড়ে চলেছে মূল-ধারার ছবিকে ব্যঙ্গ, ইঙ্গিত, কটাক্ষ। উত্তমকুমার মারা যেতে কিছু পরিচালক তাকালেন বম্বে বা দক্ষিনের দিকে আমাদের কলোনিয়াল মন বেঁকে বসল অতএব টুকলে তারকোভস্কি থেকে টোকো, আমরা সাথে আছি, ফ্রিজ ফ্রেমে ত্রুফোর সঙ্গেও, কিন্তু তা বলে হিন্দী ছবি, নেহাত হিন্দী ছবি থেকে নেওয়া মালমসলা তো আর আমাদের কালচারএ নেওয়া যায় না! আর এখানেই মজা কারণ চিরকালই শিল্প সমাজেও ধর্মীয় জাতপাতের মতই ভাগ-বাঁটোয়ারার উদাহরণ পাওয়া যাবে ওই তোমারটা লো-আর্ট, আমারটা হাই-আর্ট মাফিক ব্যাদান যা আদতে শুধু ক্ষমতা-লোভীর বন্দুকের নল ভিন্ন আর কিছু নয়। আর যে মুহূর্তে বিদেশী ছবির ইনফ্লুয়েন্স দিয়ে ছবি করা সহজ হচ্ছে না সঠিক রূপান্তরের অভাবে কিংবা বাজেটের দৈন্যতার কারণে এবং দেশের অন্য দিকে তাকানো অর্থেই টোকা, তখন সহজ আমদানী নস্টালজিয়া । বাঙ্গালীর সিনেমার ইতিহাসে দেখা যাবে এই নস্টাল-এলিমেন্টকে সর্বাগ্রে, সুনিপূণ দক্ষতায় বাঙ্গালীর অন্তঃস্থলে প্রেরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। বাঙালি মধ্যবিত্ত ৫০-৭০র দশকে সিনেমার পর্দায় চলে-ফিরে-ঘুরে বেড়াতেন, ৭০র শেষ ও ৮০তে আর্ট পর্দায় মেইনলি সাব-অল্টারন, ৯০তে এসে ঋতু সেই ৫০-৭০র বাঙ্গালীকে একদম বেড-রুমে বন্ধ করে দিলেন। অত-এব পাট-ভাঙ্গা শাড়ি পরে খালি গলায় রবি ঠাকুরের গান, চলাফেরা ওই ফ্রেমের ভেতরেই খাটের বাজু ধরে বাঁ-দিকে তাকিয়ে ডানদিকে এবং ভায়িসি-ভারসা এবং ঘন ঘন ডাইনিং টেবিলে বসে ডায়ালগ । এক ধাক্কায় জোছন দস্তিদারকে পেছনে ফেলে ঋতু বাঙ্গালী নব্য সাবান-সিরিয়ালের যে আস্থেটিক্স তার অগ্রপথিক হয়ে গেলেন ইন্ডোর, লো-কস্ট। আর সেকারণেই দরকার পড়ল অতীত-চারনের। বাংলা সিনেমার মিডল-অর্ডার একদম ঝিমিয়ে গেল দীর্ঘ সময় ধরে চরিত্রেরা ভেঙ্গে ভেঙ্গে কথা বলেন অস্ফূটে, চরিত্রের কিম্বা ছবি কারো দেহেই গতি নেই। তাই হালের সিনেমার নাম সত্যজিতের ছবির নামে রাখা হয়, কিম্বা অন্য কোন ছবির সব চরিত্রের নাম কোন না কোন সত্যজিতিয় চরিত্রের নামে। কোন ক্ষেত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যুবা-বয়সের ছবি ব্যবহার করা হয় প্রচারে। এই যে আমাদের স্বর্ণ-যুগ, যা আমরা পেরিয়ে এলাম, তাকে ছুঁয়ে দেখার প্রচেষ্টা, যা আগে বানিজ্য দিয়েছে তাকে স্পর্শ করে থাকলে কিছুটা ব্যবসা হবে সেই আশায়। এই সরলীকরণে আমরা ভুলে থাকতে চেয়েছি প্রসেনজিত নামক একটি ঘটনাকে। উত্তমকুমারের চেয়ে বড় স্টার বাংলায় আর কখনও হয়নি এই আপ্তবাক্য মাথায় রাখলেও এটা ভেবে দেখার চেষ্টা হল না যে বক্স-অপিসে উত্তম বনাম প্রসেনজিত চিত্রটি আসলে কিরকম- স্টার সিস্টেমের যে চালিকা-শক্তি সেই ব্যবসার নিরীখেই দেখে নেওয়া যেতে পারত দুজনের অবস্থান। তখন কটা হল ছিল, টিকিটের দাম কত, ছবি দেখার বিভিন্ন মিডিয়াম (ইন্টারনেট, ডিভিডি, মাল্টিপ্লেক্স ইত্যাদি), টাকার ইনফ্লেশন শিরোধার্য করেও একবার মেপে নেওয়ার সময় হয়ত এসেছে কিছু হার্ড ট্রুথ । তবে তা হবে না, কারণ কন্টেমপরারি কমার্শিয়াল বাংলা ছবি এখনও মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর অন্দরমহলে কিয়ত হলেও ব্রাত্য। শ্বেতলানা ব্যোম তাঁর The future of nostalgia বইতে বলেছেন “At first glance nostalgia is a longing for a place, but actually it is a yearning for a different time – the time of our childhood, the slower rhythm of our dreams. In a broader sense, nostalgia is a rebellion against the modern idea of time, the time of history and progress”.  নস্টালজিয়া তাই শুধুমাত্র অতীতচারীতা নয়। তাই এখানেই তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আরেকটি অনুবাদ-অসম্ভব শব্দ irony । এভাবেই তাই উঠে আসছে একটা বাংলা ছবির ট্রেন্ড যেখানে না আছে মন-কেমনের দুর্দমনীয় হাহাকার, না আছে আধুনিক গতি-বিন্যাস এক অতীতচারী শ্লথ জড়পিণ্ড এটাই irony এবং যুগপৎ  farce
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রথম বিশ্বের ইউরোপ, আমেরিকা নস্টালজিয়া বোধে পুরুষ-তান্ত্রিক বিংশ শতাব্দীর নারীর অগ্রগমনে হতচকিত, ডিস-ইলিউশনড পুরুষের আকুতি অতীত অবস্থানের প্রতি নারীবাদ দর্শনে অতীতের প্রতি পিছুটান নেই, থাকা সম্ভব নয়। সেই পুরুষ (পুরুষ এখানে একটি অবস্থান , লিঙ্গ-নিরধারক নয়) পরিচালকের সিনেমা যা পুরুষ দর্শকেরা দেখছেন আর জড়ো হচ্ছে নস্টালজিয়ার পিছুটান।
আরসেনি তারকভস্কির একটি পদ্য যা স্টকার ছবিতে তাঁর পুত্র আন্দ্রেই তারকভস্কি ব্যবহার করেন
কোন ও পাতা পুড়ে যায়নি
ভেঙ্গে যায়নি একটাও ডাল,
আজকের দিন পরিষ্কার কাঁচের মতো
কিন্তু এও সম্পূর্ণ-রূপে নয়
বাংলা সিনেমার বর্তমান স্বচ্ছ কাঁচের মত নয়, আর সে কারণেই তার শরীর জুড়ে শুধুই অতীতচারী germ , কেবল পশ্চাতপসরণ সেটাই আয়রনি, এবং আমাদের ট্র্যাজেডি ।।



(প্রথম প্রকাশ - প্রতিপদ, প্রথম বর্ষ ১ম সংখ্যা : ১৭ জানুয়ারী ২০১৪)