একটি মানসিক
হাসপাতাল। নীলকন্ঠ বাগচী ও তাঁর স্ত্রী
দূর্গা। এদিকে আলো ক্রমে ক্রমে কমে আসিতেছে। একজন
ডাক্তার। তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন নীলকন্ঠের সমস্যা ঠিক কি? ব্যারাম কি মাথার ? না, অন্য কোন
গভীর অসুখ এখন গভীরতর। গান ভেসে আসে –
“আমের তলায়
ঝামুর ঝুমুর কলাতলায় বিয়া
আইলেন গো
সোন্দরীর জামাই মুকুট মাথায় দিয়া”
তিনি জঙ্গলের
মধ্যে শুয়ে পড়লেন। পিঠে বন্দুকের বুলেট।
ছেলের প্রভাত-সূর্যের রশ্মি-স্নাত মুখ দেখবেন এখন
ইচ্ছে ছিল তাঁর। হল না। এরা তাঁর সোনার টুকরো ছেলে সব। এদের আত্মত্যাগের ইতিহাস, ভালবাসার
অঙ্গীকার নিয়ে তিনি সন্দিহান হননি কদাপি। এক দমকে
ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ঢুকে পড়েন রবীন্দ্রনাথ – “আমার অঙ্গে
অঙ্গে কে”… প্রায় লং শটে দেখা যায়। যে কথাগুলো বলানো হচ্ছে নীলকন্ঠের মুখ
দিয়ে সেকথাগুলো আর কেউ ওভাবে বলতে পারত না,
কোনদিন।
কম্যুনিস্ট
পার্টিতে ঢোকা, বেরনো, সেদিনের বাংলাদেশ, ৭০-এর
দশকের শুরুর বঙ্গভূমি –
।। ঋত্বিক কুমার ঘটক ।।
আলো আরোই
কমিয়া আসিল।
বিমলের মা
ছিল জগদ্দল। তাই অমন মাতৃহারা কান্না। জগদ্দলকে বাঁচানো যেত না ঋত্বিক – যদি ওয়াহিদাকে পাওয়া যেত ? কিন্তু
সে তো আরো বেশ কয়বছর পর। ততদিনে প্রথম ছবি
রিলিজ করেনি। দ্বিতীয় ছবি – চলেইনি। মানুষ আর যন্ত্রের ভালোবাসাটা আমরা কেউ বুঝতেই পারলাম না ! ঋত্বিক যদি কালী
ব্যানার্জির জায়গায় উত্তমকুমারকে নিতেন !
একের ভিতর ঢুকে পড়ছে অন্য – “সুবর্ণরেখা”র মৃত্যুকল্প, বাগদীবউ, তিতাসের জলোচ্ছ্বাস, নাম রেখেছি কোমল গান্ধার। নীতা বাঁচতে চেয়েও পারল না। তবু সে অতিক্রম করে সূদূর নীহারিকা।
একের ভিতর ঢুকে পড়ছে অন্য – “সুবর্ণরেখা”র মৃত্যুকল্প, বাগদীবউ, তিতাসের জলোচ্ছ্বাস, নাম রেখেছি কোমল গান্ধার। নীতা বাঁচতে চেয়েও পারল না। তবু সে অতিক্রম করে সূদূর নীহারিকা।
সুরমা দেবী
ছেড়ে গেলেন ঋত্বিককে, নীলকন্ঠকে। এরপর ফিরেও এলেন, সেবাও
করলেন। ঋত্বিক এরপরেও অসুস্থ, আবার
সুস্থতা। ফিল্ম ইন্সটিটিউটে চাকরি, ছাত্রদের ভালবাসা। তারপর ইন্দিরা গান্ধীর ওপর তথ্যচিত্র ! অথচ কংগ্রেসের
ভূমিকা, নেহরুর বোলচাল নিয়ে বিষোদ্গার – ক্ষমা করবেন
ঋত্বিক। কিংবা অসংখ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া ছবি,
পয়সার
বন্টনে টেকনিশিয়ানদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি। আবারও ক্ষমা করবেন।
কমলবাবু
এড়িয়ে গিয়েছেন। ভেবেছেন এক স্তব-স্তুতিতে মোড়া মানুষের নাম হল – ঋত্বিক
কুমার ঘটক।
ঋত্বিক একজন মানুষ ছিলেন তো ? ফ্রেইলটি নিয়েও। কমলবাবুর ছবিতে শুধুই অ্যাসাইলাম, মদ, পাগলামো। যে সময় বেছে নিয়েছেন পরিচালক, তাতে করেও উদ্ধার পাবেন না। এসবের শেষেও আছে দুটো ছবি, একাধিক নাটক। শুধুই মদ্যপান ও হতাশাকে সঙ্গী করে ? তাতে অবিশ্যি মধ্যমেধার বাঙালী সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেওয়াই চলে, আর্ট হয়ে ওঠা যায় না। কমলবাবু, আপনি ঋত্বিকের ভালবাসা দেখতে পেলেন না ? যে ভালবাসায় সব কে অগ্রাহ্য করেও “কেন চেয়ে আছ গো মা” গেয়ে ওঠা যায়। যে ভালবাসায় তেভাগা থেকে নকশাল আন্দোলন অ্যানালাইজ করেও বলা যায় – “আমি পিপলস্ আর্টিস্ট”। ‘কোমল গান্ধার’ ফ্লপ, ‘সুবর্ণরেখা’ও। কিন্তু তার পরেও থেমে থাকেনি তাঁর স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ। করেছেন তথ্যচিত্রও, ইচ্ছেতে বা টাকার জন্য। শুধুই ‘ভবা পাগলা’ কিংবা ‘ক্ষ্যাপা’ – এই ছাঁচে ফেলে দিলে সেই তিমিরেই থেকে যাব যেখানে ঋত্বিকের অনেক অবিমৃষ্যকারী মন্তব্যকেই ওঁর প্রধান বক্তব্য বলে ভ্রম করা হয়।
রামকিঙ্করের
ওপর তথ্যচিত্র যেন রামকিঙ্করের ভাস্কর্য।
কমলবাবু, আপনার ছবিতে রামকিঙ্কর এলেন না
কেন – সঠিক অভিনেতা পাওয়া যেত না? সেই ফ্রেম যা
ভাস্কর্যের মতোই বোল্ড, বিবেকী, বাঙ্ময়। ঠিক
অনেকটা রায়মশাইয়ের ‘ইনার আই’ ছবিতে
বিনোদবিহারীর পেন্টিং-এর মতো ফ্লুইডিটি যার
সর্বাঙ্গে। এবং জর্জ বিশ্বাস। শুধুমাত্র গণনাট্যের
বন্ধু হিসেবে নয়, জর্জ বিশ্বাসের গান না থাকলে দুয়ার ভেঙে পড়তই না ঝড়ে।
ঘরে ফেরার পালায় সবার ঘরে ফেরা হয় না। ঘর হারিয়ে যায়, পালটে যায়। তবু সবাই অনির্নিমেষ চেষ্টা করি – মা, মৃত্যু, ভালবাসা। “মোদের কোনো দ্যাশ নাই” – সুস্থিতি তাঁর উজ্জ্বলতর দিক না হলেও সুস্থ, স্বাভাবিক ভালবাসা নিয়ে ঋত্বিক কাটিয়ে দেন অনেক বছরই। ডিটেলড্ স্ক্রিপ্ট, ইন্ডেক্স করা – পরিপাটি।
পরের ছবি নিয়ে কি ভাবলেন ? (প্রবীর সেন কর্তৃক সাক্ষাৎকার, ১৯৭৫) –
“নবদ্বীপের পাশের কোন একটি মেয়ে, তার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া…। তাকে পাড়ার ওই ওয়াগান ব্রেকার্স… যারা সব নয়া কংগ্রেস হয়েছেন… পাইপ গান ইত্যাদি… তারা চেজ করতে আরম্ভ করে। মেয়েটার দোষের মধ্যে দোষ যে সে গরীব এক বামুনের মেয়ে, কাজেই এই গ্রাম ছেড়ে যাবার উপায় নেই। দ্বিতীয় কথা সে দেখতে সুন্দরী। এই ছোঁড়াগুলো পেছনে লেগেছে … তো আলটিমেটলি মেয়েটা … এই ছোঁড়াগুলো চেজ করতে করতে মেয়েটাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল যে মেয়েটা বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি একটা ভাল শাড়ি পরে আসি… ভেতরে ঢুকে সে পেছনের ঘর দিয়ে বেরনোর চেষ্টা করেছিল… তারপর এই ছোঁড়ারা ধরে অ্যান্ড দে এনজয়ড হার। পর পর চার পাঁচটা ছেলে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে … এরি মধ্যে ‘সত্যযুগ’-এর রিপোর্টার ছেলেটা – সে এই গ্রামেরই ছেলে – সে গিয়ে পৌঁছেছে। সে শুনে… এরা আগুন লাগিয়ে, মেয়েটা কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে মারে। এটার ভিত্তিতে আমি একটা ছবি করব।”
আজকের ২০১৩তে
দাঁড়িয়েও এই গল্প একটুও বেমানান লাগে কি?
তখনই,
সেই
মধ্য ৭০এ ফ্রেমের বাঁদিক থেকে ধোঁয়া উঠিয়ে ছুটে আসে মরুভূমির
ট্রেন – গুমগুম গুমগুম শব্দ আর সত্যজিতীয় মিউজিক। ক্যামেল রেস দেখতে থাকি আমরা, আত্মবিস্মৃত, বুভুক্ষু
– প্রায়
হলিউডি ওয়েস্টার্ণ।
“আমি শুধু এটুকু বলতে চাই যে, আমাদের
ঐতিহ্যের মধ্যে বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে আমরা
যদি আবার অনুপ্রবেশ না করি তাহলে কোন জাতীয় শিল্পই গড়ে উঠতে পারে না। ছবি তো নয়ই।”
ঋত্বিক একটি
ভুল পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিলেন। না হলে দেশভাগের ব্যথার সঙ্গে তেভাগার কান্না, মন্বন্তর ঘুরে নকশাল আন্দোলনের
ব্যর্থতার বিষ তিনি কন্ঠে ধারণ করেন
কেন?
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ভাল অভিনেতা, পরিশ্রমীও, কিন্তু অমন নাদুস ভুঁড়ি নিয়ে নীলকন্ঠ ! কেউ বলল, “ওতো ঋত্বিক নয়, ও নীলকন্ঠ!” সঠিক যুক্তি, তবে ওইটুকু বুদ্ধি থাকা দরকার যে ঋত্বিকের অনেকটাই নীলকন্ঠের মধ্যে থাকলেও অনেকটাই নেইও। নীলকন্ঠ, আফটার অল, একটা ফিকশনাল চরিত্র। তবু ঋত্বিকদের চরিত্রের কিছু টিপিক্যাল ম্যানারিজমের জন্য ‘যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো’র নীলকন্ঠকে ভাল করে অবজার্ভ করতে হয়, সেটা রেফারেন্স হিসেবে কিয়ৎ কাজ করতে পারে কিন্তু সেটাই সম্পূর্ণতা নয়। কখনোই। কমলবাবু, ‘যুক্তি…’ তে ঋত্বিক নিজেকে নিয়ে হেসেছেন, বিদ্রূপ করেছেন, তার নেপথ্যে মিথ এবং সত্য মিশে যেতে থাকে। ঋত্বিকের অন্তরকে বুঝতে বারবার অ্যানালাইজ করতে হবে তাঁর ছবিকে (তাঁর কথাতেই – “ঐতিহ্যের মধ্যে বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে”), তাঁর লেখাকে, তাঁর সম্বন্ধে সমসাময়িকদের লেখাকেও – পরমহংসের মতো করে।
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ভাল অভিনেতা, পরিশ্রমীও, কিন্তু অমন নাদুস ভুঁড়ি নিয়ে নীলকন্ঠ ! কেউ বলল, “ওতো ঋত্বিক নয়, ও নীলকন্ঠ!” সঠিক যুক্তি, তবে ওইটুকু বুদ্ধি থাকা দরকার যে ঋত্বিকের অনেকটাই নীলকন্ঠের মধ্যে থাকলেও অনেকটাই নেইও। নীলকন্ঠ, আফটার অল, একটা ফিকশনাল চরিত্র। তবু ঋত্বিকদের চরিত্রের কিছু টিপিক্যাল ম্যানারিজমের জন্য ‘যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো’র নীলকন্ঠকে ভাল করে অবজার্ভ করতে হয়, সেটা রেফারেন্স হিসেবে কিয়ৎ কাজ করতে পারে কিন্তু সেটাই সম্পূর্ণতা নয়। কখনোই। কমলবাবু, ‘যুক্তি…’ তে ঋত্বিক নিজেকে নিয়ে হেসেছেন, বিদ্রূপ করেছেন, তার নেপথ্যে মিথ এবং সত্য মিশে যেতে থাকে। ঋত্বিকের অন্তরকে বুঝতে বারবার অ্যানালাইজ করতে হবে তাঁর ছবিকে (তাঁর কথাতেই – “ঐতিহ্যের মধ্যে বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে”), তাঁর লেখাকে, তাঁর সম্বন্ধে সমসাময়িকদের লেখাকেও – পরমহংসের মতো করে।
খারাপ লাগে ভাবতে মৃত্যুর প্রায় চার দশক পরেও ঋত্বিকের কাজকে মূল্যায়ণ করার প্রচেষ্টা নিয়ে কী অনীহা। এখনও সেই সরলীকরণ, সেই আলগা ছুঁড়ে দেয়া চটকদার মন্তব্য। শুধুমাত্র সিনেমাটোগ্রাফির কারুকাজ দিয়ে, সাদা-কালোর দ্যোতনায় ফিল্ম ভাল হয়ে যায় না, ভাল হয়নি, হওয়ার কথা ছিল কি কোনদিন? কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, আপনার ছবিটি ঋত্বিক কুমার ঘটককে নিয়ে একটি অপপ্রচার – কারণ, ঋত্বিক কোন মেঘে ঢাকা তারা নন, ঋত্বিক একটি নদীর নাম। ক্ষমা করবেন।।
(প্রথম প্রকাশ - http://bookpocket.net/archives/lekha/ritwik-ekti-nodir-naam)