বাংলা
সিনেমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বাঙ্গালী নিজে। সেই বাঙালি যে সর্বদা তার্কিক এবং
কর্মক্ষেত্রে অচল। সিনেমা শিল্প-মাধ্যমটি নবীন তাই তাকে পেড়ে ফেলতে বাঙ্গালী টাইম
নিয়েছে কিছুটা। কিন্তু একবার সত্যজিত, ঋত্বিক, উত্তম হয়ে যাওয়ার পর বাঙ্গালীর
পিচ্ছিল গেঁড়ে-ন্যাকামি বেড়েই চলেছে। এই ব্যাধির মুল কারণ হতাশা ও হীনমন্যতা ।
সামগ্রিক ভারতবর্ষের নিরিখে বাঙ্গালীর ‘অধঃপতন’ বস্তুটিতে দুটো মজা আছে – এক)আধুনিক জীবনে উন্নতির
সূচক শুধুমাত্র ব্যবসাবৃত্তি ও তার বৃদ্ধি – এই ধারনা যদি
অসম্পূর্ণ তথা ভ্রান্ত মনে হয়, বাঙ্গালী তাকে যুক্তি, বুদ্ধি এবং কাজের মাধ্যমে
ভুল প্রমানিত না করে ইমোশনালি ইগ্নোর করতে গিয়ে হয়েছে তারই শিকার। এবং দুই) যে পশ্চাৎ-ধাবন নাহোক প্রায় ষাট-সত্তর বছরের
বাঙ্গালীর ইতিহাস তার প্রতি মমত্বে তাকে রিলেটিভলি আধুনিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত
করা। অতেব যে সমস্যা আমার, আপনার বাবা-জেঠাও দেখেননি, ভাবটি সেটা বোধহয় এযুগের-ই
ট্র্যাজেডী, অতেব কোন অ্যানালাইজ করার প্রয়োজন নেই, তাকে ঘিরে নিজেদের শহীদ
বানালেই শ্লাঘা হাওয়া পাবে ।
এই দুইয়ের
মেল-বন্ধনে বাঙ্গালীর শিল্প-চেতনায় উঠে আসছে নস্টালজিয়া – যা অতীতচারী, কিন্ত মেলানকলিক নয় । শুধুই ধান্দাবাজির প্রিয়-ক্ষত-চুম্বন। তাই
বাংলা থিয়েটারের হাঁড়ির দশা বেশ কয়েক দশক ধরেই । থিয়েটারকে ব্যবসায়িক না করে
পরীক্ষা-মূলক করতে গেলেও ট্যাঁকের ও বুদ্ধির জোর লাগে। বাঙ্গালীর প্রিয় ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’ র মত এখানে সিনেমাকে ভিলেন বানিয়ে হা হুতাশ করলে আর যারই
হোক, থিয়েটারের কোন লাভ হবে না। যেটা দরকার ছিল সেটা হল সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রতি
শ্রদ্ধা ও তার পতনের সম্ভাব্য বিজ্ঞানী ব্যাখ্যা । কিন্তু এখন তো থিয়েটার মানেই
গ্রুপ থিয়েটার যেমন ‘চিন্তাশীল বাংলা পত্রিকা’ মানে লিটল
ম্যাগাজিন – অর্থাৎ হাতে গোনা কয়েকটি বাদে বাকিদের কাছে দারিদ্রের
দোহাই দিয়ে খারাপ সৃষ্টি বেচে দেওয়ার অধিকার । অথচ এই কলকাতাতেই নাসিরুদ্দীন সাহের
নাটকে হাজার টাকার টিকিটে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ থাকে, আর আম-আদমি আতা বাঙালি হাত তালি
দিয়েই থাকি, থামতে পারি না। কিছুকাল আগে ফেসবুকের একটি থিয়েটার গ্রুপে টিকিটের দাম
বাড়ানোর সাজেশন দিতেই রে রে তেড়ে এলেন সুধীবৃন্দ – একে থিয়েটার
ধুঁকছে দাম আর বাড়ালে তো আর সাধারণ মানুষ আস্তেই পারবেন না, এবং ভাবটা হল – ‘আর্ট ত আমার আপনার জন্মগত অধিকার মশাই, তার কক্ষন দাম বাড়ে?’ তারা বঝেননি, শুধু দরিদ্র-নারায়ণকে সামনে রেখে খারাপ প্রযোজনা একটা ক্রিমিনাল
অফেন্স – কারণ কোন শিল্পই আমজনতার জন্য নয়, কোনদিন ছিল ও না, এবং
আপনিও গভীরে আমজনতা বল্লে মনের মধ্যে কিছু শ্রেণিকে বাদ দিয়েই ভাবেন । ৫০% লিটল
ম্যাগাজিনের যেমন বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত তেমন বেশ কিছু থিয়েটারকেও – অবিলম্বে, আবশ্যিকভাবে ।
সিনেমার
ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সিমিলার কিন্তু সেম না। থিয়েটারকে নিয়ন্ত্রণ করে যে বাঙ্গালী
সেই একই শ্রেণী ঘোরাফেরা করেন সাহিত্যের আঙ্গিনাতেও – সেই এক মিডল ক্লাস, ‘শিক্ষিত’, সবজান্তা ।সিনেমার ক্ষেত্রে তার বানিজ্যিক চরিত্রের জন্যই দেখা গেল প্রায়
তিন দশক আগে ফাটল ধরল তার জমিতে – ‘কমার্শিয়াল বনাম আর্ট’ । ৫০-৬০ এর দশকে
যা ছিল ‘ভাল - মন্দের’ পার্থক্য, সেই
দ্বন্দ্বে ঢুকে গেল পয়সার হিসেব। সেই বিভাজনকে সাদরে আহ্বান করলেন তথাকথিত ‘বুদ্ধিজীবি আর্ট ফিল্ম’ পরিচালকেরা । যে
বানিজ্যের চাহিদায় বন্ধ হয়ে গেসল সাধারণ রঙ্গালয় এবং উদ্ভব হল গ্রুপ থিয়েটারের,
সেই একই বানিজ্যিক বৈষম্যে কিন্তু উল্টভাবে টিকে গেল ‘কমার্শিয়াল’ ছবি । আর সেই গাত্রদাহে আমাদের প্রধান মিডিয়ারা কিছুকাল
আগে অব্দিও চূডান্ত অবহেলা করেছেন মূলধারার
ছবিকে – ‘অন্য-ধারার’ ছবি করে প্রসেনজিতকে জাতে উঠতে হল, তুলনায় দেব বা জিত কমসময়েই হয়ে গেলেন
গ্রহণযোগ্য – এও সেই পয়সারই খেল। বাঁদরামো শুরু অবিশ্যি ৭০-এর শেষ দিক
থেকেই। বাংলার তৎকালীন নব্য পরিচালকেরা – গৌতম, উৎপলেন্দু,
বুদ্ধদেব অল্প অল্প হালে পানি পেতে শুরু করেছেন, বিদেশে ছবি ভাল করছে, আর অনবরত
বেড়ে চলেছে মূল-ধারার ছবিকে ব্যঙ্গ, ইঙ্গিত, কটাক্ষ। উত্তমকুমার মারা যেতে কিছু
পরিচালক তাকালেন বম্বে বা দক্ষিনের দিকে – আমাদের কলোনিয়াল
মন বেঁকে বসল অতএব – টুকলে তারকোভস্কি থেকে টোকো, আমরা সাথে আছি, ফ্রিজ ফ্রেমে
ত্রুফোর সঙ্গেও, কিন্তু তা বলে হিন্দী ছবি, নেহাত হিন্দী ছবি থেকে নেওয়া মালমসলা
তো আর আমাদের ‘কালচার’এ নেওয়া যায় না!
আর এখানেই মজা কারণ চিরকালই শিল্প সমাজেও ধর্মীয় জাতপাতের মতই ভাগ-বাঁটোয়ারার উদাহরণ
পাওয়া যাবে – ওই তোমারটা ‘লো-আর্ট’, আমারটা ‘হাই-আর্ট’ মাফিক ব্যাদান যা
আদতে শুধু ক্ষমতা-লোভীর বন্দুকের নল ভিন্ন আর কিছু নয়। আর যে মুহূর্তে বিদেশী ছবির
‘ইনফ্লুয়েন্স’ দিয়ে ছবি করা সহজ
হচ্ছে না সঠিক রূপান্তরের অভাবে কিংবা বাজেটের দৈন্যতার কারণে এবং দেশের অন্য দিকে
তাকানো অর্থেই ‘টোকা’, তখন সহজ আমদানী – ‘নস্টালজিয়া’ । বাঙ্গালীর
সিনেমার ইতিহাসে দেখা যাবে এই নস্টাল-এলিমেন্টকে সর্বাগ্রে, সুনিপূণ দক্ষতায়
বাঙ্গালীর অন্তঃস্থলে প্রেরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। বাঙালি মধ্যবিত্ত
৫০-৭০র দশকে সিনেমার পর্দায় চলে-ফিরে-ঘুরে বেড়াতেন, ৭০র শেষ ও ৮০তে ‘আর্ট’ পর্দায় মেইনলি সাব-অল্টারন, ৯০তে এসে ঋতু সেই ৫০-৭০র
বাঙ্গালীকে একদম বেড-রুমে বন্ধ করে দিলেন। অত-এব পাট-ভাঙ্গা শাড়ি পরে খালি গলায়
রবি ঠাকুরের গান, চলাফেরা ওই ফ্রেমের ভেতরেই খাটের বাজু ধরে বাঁ-দিকে তাকিয়ে
ডানদিকে এবং ভায়িসি-ভারসা এবং ঘন ঘন ডাইনিং টেবিলে বসে ডায়ালগ । এক ধাক্কায় জোছন
দস্তিদারকে পেছনে ফেলে ঋতু বাঙ্গালী নব্য সাবান-সিরিয়ালের যে আস্থেটিক্স তার অগ্রপথিক হয়ে
গেলেন – ইন্ডোর, লো-কস্ট। আর সেকারণেই দরকার পড়ল অতীত-চারনের।
বাংলা সিনেমার মিডল-অর্ডার একদম ঝিমিয়ে গেল – দীর্ঘ সময় ধরে
চরিত্রেরা ভেঙ্গে ভেঙ্গে কথা বলেন অস্ফূটে, চরিত্রের কিম্বা ছবি –কারো দেহেই গতি নেই। তাই হালের সিনেমার নাম সত্যজিতের ছবির নামে রাখা হয়,
কিম্বা অন্য কোন ছবির সব চরিত্রের নাম কোন না কোন সত্যজিতিয় চরিত্রের নামে। কোন
ক্ষেত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যুবা-বয়সের ছবি ব্যবহার করা হয় প্রচারে। এই যে
আমাদের স্বর্ণ-যুগ, যা আমরা পেরিয়ে এলাম, তাকে ছুঁয়ে দেখার প্রচেষ্টা, যা আগে
বানিজ্য দিয়েছে তাকে স্পর্শ করে থাকলে কিছুটা ব্যবসা হবে সেই আশায়। এই সরলীকরণে
আমরা ভুলে থাকতে চেয়েছি প্রসেনজিত নামক একটি ঘটনাকে। উত্তমকুমারের চেয়ে বড় স্টার
বাংলায় আর কখনও হয়নি এই আপ্তবাক্য মাথায় রাখলেও এটা ভেবে দেখার চেষ্টা হল না যে
বক্স-অপিসে উত্তম বনাম প্রসেনজিত চিত্রটি আসলে কিরকম- স্টার সিস্টেমের যে
চালিকা-শক্তি সেই ব্যবসার নিরীখেই দেখে নেওয়া যেতে পারত দুজনের অবস্থান। তখন কটা
হল ছিল, টিকিটের দাম কত, ছবি দেখার বিভিন্ন মিডিয়াম (ইন্টারনেট, ডিভিডি,
মাল্টিপ্লেক্স ইত্যাদি), টাকার ইনফ্লেশন শিরোধার্য করেও একবার মেপে নেওয়ার সময় হয়ত
এসেছে কিছু হার্ড ট্রুথ । তবে তা হবে না, কারণ কন্টেমপরারি ‘কমার্শিয়াল’ বাংলা ছবি এখনও মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর অন্দরমহলে কিয়ত হলেও
ব্রাত্য। শ্বেতলানা ব্যোম তাঁর The future of nostalgia বইতে বলেছেন – “At first glance nostalgia is a longing for a place, but
actually it is a yearning for a different time – the time of our childhood, the
slower rhythm of our dreams. In a broader sense, nostalgia is a rebellion
against the modern idea of time, the time of history and progress”. নস্টালজিয়া তাই
শুধুমাত্র অতীতচারীতা নয়। তাই এখানেই তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আরেকটি
অনুবাদ-অসম্ভব শব্দ – irony । এভাবেই তাই উঠে
আসছে একটা বাংলা ছবির ট্রেন্ড যেখানে না আছে মন-কেমনের দুর্দমনীয় হাহাকার, না আছে
আধুনিক গতি-বিন্যাস – এক অতীতচারী শ্লথ জড়পিণ্ড – এটাই irony এবং যুগপৎ farce ।
এখানে
উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রথম বিশ্বের ইউরোপ, আমেরিকা নস্টালজিয়া বোধে
পুরুষ-তান্ত্রিক – বিংশ শতাব্দীর নারীর অগ্রগমনে হতচকিত, ডিস-ইলিউশনড পুরুষের
আকুতি অতীত অবস্থানের প্রতি – নারীবাদ দর্শনে
অতীতের প্রতি পিছুটান নেই, থাকা সম্ভব নয়। সেই ‘পুরুষ’ (‘পুরুষ’ এখানে একটি
অবস্থান , লিঙ্গ-নিরধারক নয়) পরিচালকের সিনেমা যা ‘পুরুষ’ দর্শকেরা দেখছেন – আর জড়ো হচ্ছে
নস্টালজিয়ার পিছুটান।
আরসেনি
তারকভস্কির একটি পদ্য যা ‘স্টকার’ ছবিতে তাঁর পুত্র আন্দ্রেই তারকভস্কি ব্যবহার করেন –
“কোন ও পাতা পুড়ে যায়নি
ভেঙ্গে যায়নি একটাও ডাল,
আজকের দিন পরিষ্কার কাঁচের মতো
কিন্তু এও সম্পূর্ণ-রূপে নয়”
বাংলা সিনেমার বর্তমান স্বচ্ছ কাঁচের মত
নয়, আর সে কারণেই তার শরীর জুড়ে শুধুই অতীতচারী germ , কেবল
পশ্চাতপসরণ – সেটাই আয়রনি, এবং আমাদের ট্র্যাজেডি ।।
(প্রথম প্রকাশ - প্রতিপদ, প্রথম বর্ষ ১ম সংখ্যা : ১৭ জানুয়ারী ২০১৪)
bhalo laglo..
ReplyDeleteসাইট থেকে লেখা তুলে তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিতে দিতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু পংক্তিকে হাইলাইট করে দেয়া। যাইহোক, সেটা করতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি, লেখায় যে বিষয়গুলিকে তুমি ছুঁয়ে গেলে, তার সবটাই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ReplyDeleteAha .... sadhubad !
ReplyDelete