['একক
মাত্রা'-য় (পঞ্চদশ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা,নভেম্বর ২০১৪) প্রকাশিত | নীচের
লেখাটি মূল লেখা, পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটি এর থেকে কিছুটা সম্পাদিত ]
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পণ্ডিত মাধব প্রসাদ ভারতীয় ও হলিউড সিনেমার বিভাজন উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে ভারতীয় সিনেমা ভিন্নধর্মী হেটেরজিনিযাস উত্পাদনের নমুনা ও হলিউড সিনেমা সিরিয়াল উত্পাদনের ফর্ম মেনেই। হলিউড সিনেমার কেন্দ্রে অবস্থান করে 'গল্প' যা অনেকক্ষেত্রেই 'বাস্তববাদী' এবং এর ফলে দর্শকদের আইডেনটিফিকশনের সম্ভাবনা বেশি এবং তা স্বয়ংক্রিয় হয় । প্রফেসর প্রসাদের মত মেনে ভারতীয় 'বাণিজ্যিক' সিনেমা, ('সমান্তরাল'/'আর্ট' ফিল্ম রীতির থেকে 'বাণিজ্যিক' ভিন্নতা মোটামুটি বুঝি এটা ধরে নিলে) আসলে একটি সমন্বয় - একাধিক নাচ-গান সিকোয়েন্স, গল্প, যুদ্ধ/প্রতিহিংসা, মেলোড্রামা এবং তারকা । ফিল্মের সাফল্য এইসব একাধিক 'চাক্ষুষ (এবং শ্রবণেন্দ্রিয় সংক্রান্ত) আনন্দ'-এর কারনেই, কোনো একটির উপর নির্ভর করে নয় । পশ্চিমী দর্শকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য 'ক্লাসিকাল ভয়ার দৃষ্টি' বা 'গেজ' (gaze) তাই ভারতীয় দর্শকের ক্ষেত্রে বেমানান কারন তাঁর 'দৃষ্টি' বিভিন্ন উপ-কনটেক্সট দ্বারা ক্রমাগত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হতে হতে সাবভার্টেড হয় । তাই, ভারতীয় বাণিজ্যিক মূলধারার সিনেমা 'বাস্তবতা' থেকে ভিন্ন 'গীতিনাটক', এর মেলোড্রামায় নিহিত আছে এক অবাস্তব ইচ্ছা-সিদ্ধি - যা দর্শক জানেন আর সেটা জেনেই তিনি ছবিটির কাছে নিজেকে সমর্পন করেন।
আন্তর্জাতিক স্তরে ফিল্ম পণ্ডিতদের একাংশ অনেকদিন ধরেই হলিউডি ছবির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তুলে ধরতে চেয়েছেন 'জাতীয়' ছবি কে । হলিউডের স্টুডিও সিস্টেম যা তাদের সাফল্যের বড় উদাহরন , তাকে নস্যাত করে জাতীয় ছবির প্রয়োজন থেকেই জন্ম নেয় নুভেল ভাগ থেকে আরম্ভ করে আরও অনেক সিনেমা আন্দোলনের । আর এই যুদ্ধের মূল চালিকা ছিল সিনেমা একটি 'শিল্প' মাধ্যম নাকি শুধুমাত্র একটি বাণিজ্যিক পণ্য যাকে খুচরো সুপারমলে কিনতে পাওয়া যাবে পকেটে পয়সা থাকলেই - এই আপাত দ্বন্দ। বিশ্ব চলচ্চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে সাংস্কৃতিক নির্দিষ্টতার প্যারাডিমে যেকোনো দেশের চলচ্চিত্রেই 'জাতীয়' র পাশেই অবস্থিত আছে একাধিক 'স্থানীয়' ধারা। অর্থাত হলিউড কে ধরলে এই হায়ারার্কি অনেকটা হলিউড -> জাতীয় ছবি -> স্থানীয় ছবি। ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে সমস্যা আরো জটিল কারন এই স্থানিক ধারার সংখ্যা সাধারন ভাবে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই বেশী। ভারত তার বৈচিত্র্য সঙ্গে নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম সিনেমা উৎপাদনকরি দেশ - ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের বিবিধতায় একটি 'জাতীয়' সিনেমা সংজ্ঞায়িত করা প্রকৃতপক্ষে একটি চ্যালেঞ্জ । আর সেই সমস্যা বেড়ে যায় যখন মিডিয়ার একটা বড় অংশ এবং অনেকক্ষেত্রে সরকারী প্রচারেও 'ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্রের' হিসাবে হিন্দি 'বলিউড' সিনেমা চিহ্নিত করার একটা অসুস্থ প্রয়াস দেখা যায় । দক্ষিণ মূলধারার ছবির রাজস্ব বলিউড ছায়াছবির তুলনীয় আর সেই যুক্তিতে 'জাতীয় সিনেমা' র তকমা দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রির ওপরেও অর্পিত হতে পারত । আরেকটু গভীরে গেলে বোঝা যাবে এই নিয়ন্ত্রন আসছে এক সরকারী অনুশাসন থেকে যেখানে দিল্লির রাজনৈতিক পরিমন্ডল চালিত হয় মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতের হিন্দি-ভাষী প্রতিনিধিদের দ্বারা ।
দক্ষিণ (তামিল, তেলেগু, কন্নড় এবং মালয়ালি) জনপ্রিয় মূলধারার সিনেমা, পশ্চিম (মারাঠী এবং গুজরাটি সিনেমা) এবং পূর্ব (বাংলা, ওড়িয়া, অসমিয়া) আইনসঙ্গতভাবে 'ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্রের' আওতায় বলিউডের সঙ্গে এরাও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে । আর এই 'মূলধারার বাণিজ্যিক' ছবির পাশে এখন ও সক্রিয় 'বিকল্প' ছবি (যদিও বলিউডের ছবিতে এই দুই ধারার পার্থক্য ক্রমশ কমে আসছে) । এই ভিন্নতার কারনেই ভারতীয় সিনেমার কমন ডিক্সন অফ এক্সপ্রেসন জটিল - আমাদের 'ভারতবর্ষ '-এর ভিতরেই লুকিয়ে আছে আরো অনেক গুলো দেশ, এবং সেই বিভিন্নতা ভৌগলিক, সামাজিক, ভাষাগত এবং অর্থনৈতিক । এখানে স্বীকার করা যেতে পারে যে এই কমন ভিউয়ার একস্পিরিয়েনস অনেকটাই আসে হিন্দি ছবি তে - হিন্দি ভাষার সার্বিক গম্যতার কারনে , 'জাতীয়' স্টারদের নিয়োগে, সাধারন ভারতীয় সেন্টিমেন্ট মেনে বিদেশের অথবা দেশাত্মবাদী পটভূমিকায় এবং সর্বপরি এক রোম্যান্টিক আবহে যার জাঁক-জমক অনেকক্ষেত্রেই আঞ্চলিক সনাক্তকরনকে ইচ্ছাকৃত ভাবে সরিয়ে রাখতে সফল হয় ।
দুর্ভাগ্য-বশত:, আমাদের দেশের গরিষ্ঠ সংস্কৃতি গবেষণায় তত্ত্ব আধিক্য সমৃদ্ধিশালী পশ্চিমের নান্দনিক মান দ্বারা প্রভাবিত এবং পরিচালিত হয়েছে । ফিল্ম-আন্দোলনের প্রারম্ভ থেকেই ভারতবর্ষে চলচ্চিত্র সমালোচক মূলত পশ্চিমী ধ্যান-ধারনা কে আত্মীকরণের চেষ্টায় ব্রতী থেকেছে, পাশ্চাত্য তত্ত্ব দ্বারা 'আলোকপ্রাপ্ত' হওয়াকেই শ্রেয় মনে করেছে । এর ফলে বিদেশী তত্ত্বকে দেশী সংস্কৃতিতে মেলাতে গিয়ে বিফল হওয়া মাত্রেই দেশ-জাত সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা ঘনীভূত হয়েছে । এই বোধ (কিংবা বোধ-হীনতা) থেকেই জন্ম নেয় এই মতবাদ যে 'জনপ্রিয়' মাত্রেই 'অসংস্কৃত' । এর ফলে বানিজ্যিক ধারার ছবির কুটোটিও নাড়া যায়নি কিন্তু । বরঞ্চ ,ভারতীয় উপ-মহাদেশকে সুবৃহত সম্ভাব্য বাজার হিসেবে চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলো হঠাত ভারতীয় বানিজ্যিক ছবি এবং জনপ্রিয় তারকাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়ে উঠেছে ।
আমাদের দেশের চলচ্চিত্র চর্চা তাহলে কোন সন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে? প্রয়োজন স্ব-বিশ্বাস, নিজের সংস্কৃতির প্রতি আস্থা এবং নিজেদের বিভিন্নতা কে মর্যাদা দেওয়া ।এইটা বাস্তব যে প্রেমের দৃশ্যে রাস্তায় একশ জন মানুষ নাচ করে প্রেম নিবেদন করেন না যেমন অধিকাংশ ভারতীয় বানিজ্যিক ছবিতে দেখা যায় , ঠিক যেভাবে হলিউডি 'অবতার' ও কোন পার্থিব বাস্তবতা নয় এবং 'স্পিড' কিম্বা তার সিকোয়েলগুলো ও নয় । কিন্তু মাথায় রাখার সময় এসেছে যে শুধুমাত্র 'বাস্তবতা'র দোহাই সিনেমায় অপ্রাসঙ্গিক - সিনেমা ফ্যান্টাসি, সিনেমা স্বপ্ন, সিনেমা বাস্তবের 'বিভ্রম', বাস্তব নয়, আর সেকারনেই তার প্রধান উদ্দেশ্য শব্দটির সব সম্ভব কনোটেশন নিয়েই 'মনোরঞ্জন' । তাই ভারতীয় সিনেমার চর্চা ভারতীয় সিনেমাকে ধরেই করতে হবে, বিদেশী, ধার করা তত্ত্বের নিরিখে নয় - গর্ব ও নিষ্ঠা দিয়ে। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র দার্শনিক গাস্ত রোবের্জ ভারতীয় চলচ্চিত্র থিওরির প্রসঙ্গে স্পষ্ট বলেছেন -“We need a fresh film theory. It is only when we shall define the popular cinema, not in terms of what we would like it to be but in terms of what it actually is, that we shall be able to discern the good from the bad among the popular films…What we need now most urgently is a new theory – or if you wish a new vision”.
শাস্ত্রীয় পশ্চিমী চলচ্চিত্র তত্ত্বের আদিম ফোকাস 'gaze' এবং 'spectatorship' ধারণায় ।এর সঙ্গে যুক্ত হয় লিঙ্গ-ধারনা এবং জন্ম নেয় 'ভয়ার' তত্ত্ব । ভারতীয় প্রেক্ষাপটে নারী শরীরের পাবলিক এক্সপোজার পশ্চিমা বিশ্বের চেয়ে ভিন্ন (গ্রামীণ ভারতে যেমন স্নানরতা নারী কোন ভয়ার বিষয় নয় , তা পরিপ্রেক্ষিতে সাধারন ঘটনা মাত্র)। তাই ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিনির্মানে প্রয়োজন মাটির শিকড় থেকে তাদের বিশ্লেষণ, কয়েক সাধারণ, গ্রাহ্য কাঠামো তৈরি করে নিয়ে । সেই কাঠামো দিয়ে সব আঙ্গিকের ভারতীয় ছবি বিশ্লেষিত না হতে পারে - কিন্তু আরম্ভটা শুরু হওয়া দরকার - কাঠামোকে সময়ের সঙ্গে উন্নত করে যাওয়া, প্রয়োজনে নতুন কাঠামো তৈরী করা সেই মনোভাব নিয়েই ।পাশ্চাত্য তত্ত্ব আলোকে ভারতীয় সিনেমা চর্চা আমাদের ক্রমান্বয়ে সংশয়ী করে তুলেছে, আমরা ভাবতে বাধ্য হয়েছি আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় নিকৃষ্ট । এই নতুন দৃষ্টি বিকাশ একটি কঠিন বিষয়, এবং সেই কাজে এগিয়ে আসতে হবে - ফিল্ম সমালোচক, ফিল্ম পরিচালক, ফিল্ম টেকনিশিয়্ন, ফিল্ম প্রযোজক এবং ফিল্ম দর্শক - সবাইকেই ।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পণ্ডিত মাধব প্রসাদ ভারতীয় ও হলিউড সিনেমার বিভাজন উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে ভারতীয় সিনেমা ভিন্নধর্মী হেটেরজিনিযাস উত্পাদনের নমুনা ও হলিউড সিনেমা সিরিয়াল উত্পাদনের ফর্ম মেনেই। হলিউড সিনেমার কেন্দ্রে অবস্থান করে 'গল্প' যা অনেকক্ষেত্রেই 'বাস্তববাদী' এবং এর ফলে দর্শকদের আইডেনটিফিকশনের সম্ভাবনা বেশি এবং তা স্বয়ংক্রিয় হয় । প্রফেসর প্রসাদের মত মেনে ভারতীয় 'বাণিজ্যিক' সিনেমা, ('সমান্তরাল'/'আর্ট' ফিল্ম রীতির থেকে 'বাণিজ্যিক' ভিন্নতা মোটামুটি বুঝি এটা ধরে নিলে) আসলে একটি সমন্বয় - একাধিক নাচ-গান সিকোয়েন্স, গল্প, যুদ্ধ/প্রতিহিংসা, মেলোড্রামা এবং তারকা । ফিল্মের সাফল্য এইসব একাধিক 'চাক্ষুষ (এবং শ্রবণেন্দ্রিয় সংক্রান্ত) আনন্দ'-এর কারনেই, কোনো একটির উপর নির্ভর করে নয় । পশ্চিমী দর্শকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য 'ক্লাসিকাল ভয়ার দৃষ্টি' বা 'গেজ' (gaze) তাই ভারতীয় দর্শকের ক্ষেত্রে বেমানান কারন তাঁর 'দৃষ্টি' বিভিন্ন উপ-কনটেক্সট দ্বারা ক্রমাগত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হতে হতে সাবভার্টেড হয় । তাই, ভারতীয় বাণিজ্যিক মূলধারার সিনেমা 'বাস্তবতা' থেকে ভিন্ন 'গীতিনাটক', এর মেলোড্রামায় নিহিত আছে এক অবাস্তব ইচ্ছা-সিদ্ধি - যা দর্শক জানেন আর সেটা জেনেই তিনি ছবিটির কাছে নিজেকে সমর্পন করেন।
আন্তর্জাতিক স্তরে ফিল্ম পণ্ডিতদের একাংশ অনেকদিন ধরেই হলিউডি ছবির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তুলে ধরতে চেয়েছেন 'জাতীয়' ছবি কে । হলিউডের স্টুডিও সিস্টেম যা তাদের সাফল্যের বড় উদাহরন , তাকে নস্যাত করে জাতীয় ছবির প্রয়োজন থেকেই জন্ম নেয় নুভেল ভাগ থেকে আরম্ভ করে আরও অনেক সিনেমা আন্দোলনের । আর এই যুদ্ধের মূল চালিকা ছিল সিনেমা একটি 'শিল্প' মাধ্যম নাকি শুধুমাত্র একটি বাণিজ্যিক পণ্য যাকে খুচরো সুপারমলে কিনতে পাওয়া যাবে পকেটে পয়সা থাকলেই - এই আপাত দ্বন্দ। বিশ্ব চলচ্চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে সাংস্কৃতিক নির্দিষ্টতার প্যারাডিমে যেকোনো দেশের চলচ্চিত্রেই 'জাতীয়' র পাশেই অবস্থিত আছে একাধিক 'স্থানীয়' ধারা। অর্থাত হলিউড কে ধরলে এই হায়ারার্কি অনেকটা হলিউড -> জাতীয় ছবি -> স্থানীয় ছবি। ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে সমস্যা আরো জটিল কারন এই স্থানিক ধারার সংখ্যা সাধারন ভাবে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই বেশী। ভারত তার বৈচিত্র্য সঙ্গে নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম সিনেমা উৎপাদনকরি দেশ - ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের বিবিধতায় একটি 'জাতীয়' সিনেমা সংজ্ঞায়িত করা প্রকৃতপক্ষে একটি চ্যালেঞ্জ । আর সেই সমস্যা বেড়ে যায় যখন মিডিয়ার একটা বড় অংশ এবং অনেকক্ষেত্রে সরকারী প্রচারেও 'ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্রের' হিসাবে হিন্দি 'বলিউড' সিনেমা চিহ্নিত করার একটা অসুস্থ প্রয়াস দেখা যায় । দক্ষিণ মূলধারার ছবির রাজস্ব বলিউড ছায়াছবির তুলনীয় আর সেই যুক্তিতে 'জাতীয় সিনেমা' র তকমা দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রির ওপরেও অর্পিত হতে পারত । আরেকটু গভীরে গেলে বোঝা যাবে এই নিয়ন্ত্রন আসছে এক সরকারী অনুশাসন থেকে যেখানে দিল্লির রাজনৈতিক পরিমন্ডল চালিত হয় মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতের হিন্দি-ভাষী প্রতিনিধিদের দ্বারা ।
দক্ষিণ (তামিল, তেলেগু, কন্নড় এবং মালয়ালি) জনপ্রিয় মূলধারার সিনেমা, পশ্চিম (মারাঠী এবং গুজরাটি সিনেমা) এবং পূর্ব (বাংলা, ওড়িয়া, অসমিয়া) আইনসঙ্গতভাবে 'ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্রের' আওতায় বলিউডের সঙ্গে এরাও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে । আর এই 'মূলধারার বাণিজ্যিক' ছবির পাশে এখন ও সক্রিয় 'বিকল্প' ছবি (যদিও বলিউডের ছবিতে এই দুই ধারার পার্থক্য ক্রমশ কমে আসছে) । এই ভিন্নতার কারনেই ভারতীয় সিনেমার কমন ডিক্সন অফ এক্সপ্রেসন জটিল - আমাদের 'ভারতবর্ষ '-এর ভিতরেই লুকিয়ে আছে আরো অনেক গুলো দেশ, এবং সেই বিভিন্নতা ভৌগলিক, সামাজিক, ভাষাগত এবং অর্থনৈতিক । এখানে স্বীকার করা যেতে পারে যে এই কমন ভিউয়ার একস্পিরিয়েনস অনেকটাই আসে হিন্দি ছবি তে - হিন্দি ভাষার সার্বিক গম্যতার কারনে , 'জাতীয়' স্টারদের নিয়োগে, সাধারন ভারতীয় সেন্টিমেন্ট মেনে বিদেশের অথবা দেশাত্মবাদী পটভূমিকায় এবং সর্বপরি এক রোম্যান্টিক আবহে যার জাঁক-জমক অনেকক্ষেত্রেই আঞ্চলিক সনাক্তকরনকে ইচ্ছাকৃত ভাবে সরিয়ে রাখতে সফল হয় ।
দুর্ভাগ্য-বশত:, আমাদের দেশের গরিষ্ঠ সংস্কৃতি গবেষণায় তত্ত্ব আধিক্য সমৃদ্ধিশালী পশ্চিমের নান্দনিক মান দ্বারা প্রভাবিত এবং পরিচালিত হয়েছে । ফিল্ম-আন্দোলনের প্রারম্ভ থেকেই ভারতবর্ষে চলচ্চিত্র সমালোচক মূলত পশ্চিমী ধ্যান-ধারনা কে আত্মীকরণের চেষ্টায় ব্রতী থেকেছে, পাশ্চাত্য তত্ত্ব দ্বারা 'আলোকপ্রাপ্ত' হওয়াকেই শ্রেয় মনে করেছে । এর ফলে বিদেশী তত্ত্বকে দেশী সংস্কৃতিতে মেলাতে গিয়ে বিফল হওয়া মাত্রেই দেশ-জাত সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা ঘনীভূত হয়েছে । এই বোধ (কিংবা বোধ-হীনতা) থেকেই জন্ম নেয় এই মতবাদ যে 'জনপ্রিয়' মাত্রেই 'অসংস্কৃত' । এর ফলে বানিজ্যিক ধারার ছবির কুটোটিও নাড়া যায়নি কিন্তু । বরঞ্চ ,ভারতীয় উপ-মহাদেশকে সুবৃহত সম্ভাব্য বাজার হিসেবে চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলো হঠাত ভারতীয় বানিজ্যিক ছবি এবং জনপ্রিয় তারকাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়ে উঠেছে ।
আমাদের দেশের চলচ্চিত্র চর্চা তাহলে কোন সন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে? প্রয়োজন স্ব-বিশ্বাস, নিজের সংস্কৃতির প্রতি আস্থা এবং নিজেদের বিভিন্নতা কে মর্যাদা দেওয়া ।এইটা বাস্তব যে প্রেমের দৃশ্যে রাস্তায় একশ জন মানুষ নাচ করে প্রেম নিবেদন করেন না যেমন অধিকাংশ ভারতীয় বানিজ্যিক ছবিতে দেখা যায় , ঠিক যেভাবে হলিউডি 'অবতার' ও কোন পার্থিব বাস্তবতা নয় এবং 'স্পিড' কিম্বা তার সিকোয়েলগুলো ও নয় । কিন্তু মাথায় রাখার সময় এসেছে যে শুধুমাত্র 'বাস্তবতা'র দোহাই সিনেমায় অপ্রাসঙ্গিক - সিনেমা ফ্যান্টাসি, সিনেমা স্বপ্ন, সিনেমা বাস্তবের 'বিভ্রম', বাস্তব নয়, আর সেকারনেই তার প্রধান উদ্দেশ্য শব্দটির সব সম্ভব কনোটেশন নিয়েই 'মনোরঞ্জন' । তাই ভারতীয় সিনেমার চর্চা ভারতীয় সিনেমাকে ধরেই করতে হবে, বিদেশী, ধার করা তত্ত্বের নিরিখে নয় - গর্ব ও নিষ্ঠা দিয়ে। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র দার্শনিক গাস্ত রোবের্জ ভারতীয় চলচ্চিত্র থিওরির প্রসঙ্গে স্পষ্ট বলেছেন -“We need a fresh film theory. It is only when we shall define the popular cinema, not in terms of what we would like it to be but in terms of what it actually is, that we shall be able to discern the good from the bad among the popular films…What we need now most urgently is a new theory – or if you wish a new vision”.
শাস্ত্রীয় পশ্চিমী চলচ্চিত্র তত্ত্বের আদিম ফোকাস 'gaze' এবং 'spectatorship' ধারণায় ।এর সঙ্গে যুক্ত হয় লিঙ্গ-ধারনা এবং জন্ম নেয় 'ভয়ার' তত্ত্ব । ভারতীয় প্রেক্ষাপটে নারী শরীরের পাবলিক এক্সপোজার পশ্চিমা বিশ্বের চেয়ে ভিন্ন (গ্রামীণ ভারতে যেমন স্নানরতা নারী কোন ভয়ার বিষয় নয় , তা পরিপ্রেক্ষিতে সাধারন ঘটনা মাত্র)। তাই ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিনির্মানে প্রয়োজন মাটির শিকড় থেকে তাদের বিশ্লেষণ, কয়েক সাধারণ, গ্রাহ্য কাঠামো তৈরি করে নিয়ে । সেই কাঠামো দিয়ে সব আঙ্গিকের ভারতীয় ছবি বিশ্লেষিত না হতে পারে - কিন্তু আরম্ভটা শুরু হওয়া দরকার - কাঠামোকে সময়ের সঙ্গে উন্নত করে যাওয়া, প্রয়োজনে নতুন কাঠামো তৈরী করা সেই মনোভাব নিয়েই ।পাশ্চাত্য তত্ত্ব আলোকে ভারতীয় সিনেমা চর্চা আমাদের ক্রমান্বয়ে সংশয়ী করে তুলেছে, আমরা ভাবতে বাধ্য হয়েছি আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় নিকৃষ্ট । এই নতুন দৃষ্টি বিকাশ একটি কঠিন বিষয়, এবং সেই কাজে এগিয়ে আসতে হবে - ফিল্ম সমালোচক, ফিল্ম পরিচালক, ফিল্ম টেকনিশিয়্ন, ফিল্ম প্রযোজক এবং ফিল্ম দর্শক - সবাইকেই ।
No comments:
Post a Comment